প্রায় একশো বিশ বছর আগের কথা ।
গ্রিসের উপকূলে সমুদ্রে ডুবুরিরা নামত স্পঞ্জের খোঁজে। স্পঞ্জের বেশ চাহিদা আছে সারা বিশ্বে। স্পঞ্জ খুঁজতে গিয়ে কখনও কখনও ঐতিহাসিক যুগে ডুবে যাওয়া পুরনো জাহাজের সন্ধান পেয়ে গেলে তারা খুব খুশি হত। প্রাচীন জাহাজ মানেই গুপ্তধন । দুচারটে গ্রিক দ্রাখমা (স্বর্ণমুদ্রা) পেলে তো কথাই নেই। না হলেও পুরনো মূর্তি, চিনেমাটির অ্যাম্ফোরা ( মদ বা অন্য তরল রাখার পাত্র), সবুজ হয়ে যাওয়া ব্রঞ্জের বাসন বা অস্ত্রশস্ত্র…. সবের জন্যই মিউজিয়াম বা ব্যক্তিগত সংগ্রাহকরা ভালো দাম দিয়ে থাকে।
এইরকম একজন স্পঞ্জ ডুবুরি ১৯০০ খৃষ্টাব্দে গ্রিসের অ্যান্টিকিথেরা দ্বীপের কাছে খুঁজে পেল এক ডুবে যাওয়া প্রাচীন জাহাজের ধ্বংসাবশেষ, যার মধ্যে ছিল ব্রঞ্জ আর মার্বেলের তৈরি মূর্তি এবং ক্ষয়ে যাওয়া চারটে ব্রঞ্জের টুকরো । সমস্ত জিনিস সে এথেন্সর National Museum of Archaeology তে জমা দেয়।
ব্রঞ্জের টুকরোগুলো পরীক্ষা করে মনে হয় তার মধ্যে খাঁজ কাটা বেশ কয়েকটি চাকা (gear) আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধরে নেন এটা জাহাজের দিক নির্ণয় করার কোন যন্ত্র । জাহাজের বয়স তখন নির্ধারণ করা হয় খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী। তখনও রেডিওকার্বন ডেটিং বা অন্যান্য প্রাচীনত্ব নিরূপক আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কার হয় নি।
এরপর পঞ্চাশ বছর ঐ মরচে ধরা ব্রঞ্জের টুকরো গুলো মিউজিয়ামের গুদামঘরে পড়ে ছিল । ১৯৫৫ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক আগ্রহী হয়ে সেগুলি নিয়ে এক্স রে করেন। এক্স রে ছবি তোলার পর তিনি হতবাক হয়ে দেখেন …. যন্ত্রটি যেরকম মনে হয়েছিল তার থেকে ঢের বেশি জটিল। ছবি দেখে বোঝা যায় তার মধ্যে অন্তত ৩৯ টি গিয়ার আছে অনেকগুলি পাতলা সমান্তরাল ধাতব পাতের উপর আটকানো। উপর থেকে একটি অনুভূমিক চাকা ঘোরালে সবগুলিকেই ঘোরানো যায় । কিন্তু সব গিয়ারগুলির ঘোরার গতি আলাদা, অর্থাৎ যন্ত্রবিদ্যার ভাষায় এগুলি এক differential gear system.
গবেষক ডেরেক প্রাইস বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এটি একটি ‘অ্যানালগ কম্পিউটার’ ছিল। চন্দ্র, সূর্য, এবং পাঁচটি গ্রহের, বৃহস্পতি, শনি, মঙ্গল, বুধ ও শুক্রের গতিবিধি ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য ব্যবহার হত।
অক্ষত অবস্থায় এটি একটি কাঠের বাক্সের মধ্যে রাখা হত । আকার খুব বড় নয়… এক ফুট দৈর্ঘ, ছ ইঞ্চি উচ্চতা এবং তিন ইঞ্চি প্রস্থ । ডেরেক প্রাইস ১৯৭৪ সালে এর উপর এক প্রবন্ধ লেখেন । তাতে উনি যন্ত্রটি তৈরির সময় লেখেন ৮৭ খৃষ্টপূর্বাব্দ।
সারা পৃথিবীতে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে হৈচৈ শুরু হয়ে যায় এই লেখা প্রকাশ হবার পর…. “এ কি করে সম্ভব “? এত উন্নত প্রযুক্তি তো পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে মানুষের অজ্ঞাত ছিল। তাহলে এত প্রাচীন যুগে গ্রিসের বৈজ্ঞানিকেরা কি করে এত জটিল ও সুক্ষ যন্ত্র বানিয়েছিল ?”
প্রাচীন গ্রিস দর্শনশাস্ত্রে প্রচুর উন্নতি করেছিল তা অনস্বীকার্য । কিন্তু এত উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যা তো এতদিন আগে অকল্পনীয় ব্যাপার । প্রাতিষ্ঠানিক পন্ডিতরা বিষয়টিকে হেসে উড়িয়ে পারলেন না কারণ যন্ত্রটি তো সবার চোখের সামনে আছে।
তাঁদের অবাক হওয়া তখনও বাকি ছিল। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক, মাইক এডমন্ড এবং টোনি ফ্রীথ কম্পিউটার টোমোগ্রাফি অর্থাৎ CAT Scan করে ঐ যন্তটির মধ্যে প্রায় মুছে যাওয়া ছোট ছোট অক্ষরের লেখা খুঁজে পান এবং ডেরেক প্রাইসের মত সমর্থন করেন । ইতিমধ্যে রেডিওকার্বন ডেটিং পদ্ধতির আরও উন্নতি হয় এবং জানা যায় যন্ত্রটি আরও পুরনো… সম্ভবত আরও অন্তত পঞ্চাশ বছর। গ্রিক ঐতিহাসিক সিসেরো’র লেখায় এই ধরনের একটি যন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া গেল। তিনি লিখেছেন রোডস এর পন্ডিত পসিডোনিয়াস একটি যন্ত্র তৈরি করেছেন যা প্রতি ঘূর্ণনে চন্দ্র সূর্য ও পাঁচটি গ্রহের গতিবিধি নিখুঁত ভাবে দেখিয়ে দিতে পারে।
যন্ত্রটি গবেষক মহলে Antikythera Mechanism বলে পরিচিত । যন্ত্রটির সাহায্যে সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় আগে থেকে জানা যেত এবং আরও কিছু গ্রহ নক্ষত্র সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যেত বলে মনে করছেন গবেষকরা। তাঁদের মধ্যে লন্ডন সায়েন্স মিউজিয়ামের প্রাক্তন কিউরেটর মাইকেল রাইট অন্যতম। গবেষকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে যন্ত্রটিকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছেন।
তাহলে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কি উন্নত জ্ঞান বিজ্ঞান ছিল যা কোন কারনে হারিয়ে গেছে ? কারা শিখিয়েছিল তাদের সেই বিজ্ঞান ?

প্রত্নতাত্ত্বিকরা এ ধরনের প্রত্ননিদর্শনকে বলেন OOPArt ( Out Of Place Artifact)। ঘুরিয়ে বললে ” এ জিনিসটি এখানে / এ সময়ে কি করে থাকা সম্ভব ?” Antikythera mechanism নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে।
তথ্যসূত্র:
1) Decoding the Antikythera mechanism: The first computer. Smithsonian Magazine
2) Antikythera mechanism : description, purpose and facts. Britannica.com
3) Wikipedia
4) Mysterious Lands & Peoples ; Time-Life
ছবি : Internet
শ্যামল ঘোষ