লিলি এলবে, একজন ড্যনিশ মহিলা, ইতিহাস যাকে মনে রাখবে একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি যে কিনা তখন পর্যন্ত জানামতে প্রথম লিঙ্গ পরিবর্তনকারী অপারেশনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন।
অাইনার ম্যাগনাস এ্যানড্রেয়াস ওয়েগনার, জন্ম নেন ১৮৮২ সালের ২৮ ডিসেম্বর, ডেনমার্কে। যিনি মৃত্যুবরণ করেন লিলি এলবে হিসেবে ১৯৩১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, ৪৮ বছর বয়সে। ধরে নেয়া হয় এলবের জন্মসাল ১৮৮২, কিন্তু কিছু জায়গায় তা ১৮৮৬ বলা হয়েছে সেইকালে তার পরিচিতি লুকোনোর জন্য। কিন্তু তার স্ত্রী গ্রেডা গটলিয়েব নিশ্চিত করেছেন যে এলবে ১৮৮২তেই জন্মেছেন। তাদের বিয়ে হয় ১৯০৪ সনে যখন তারা কলেজে পড়ছিলেন।
অাইনার ওয়েগনার অার গ্রেডা গটলিয়েবের প্রথম দেখা হয় কোপেনহেগেনের রয়্যাল ডেনিশ একাডেমি অফ ফাইন অার্টসে। তখন গ্রেডার বয়স ছিলো ১৯ অার অাইনারের ২২। তারা দুজন সে সংস্থার ইলাস্ট্রেটরের কাজ করছিলেন। অাইনারের কাজ ছিলো ল্যান্ডস্কেপিং পেইন্টিংস অার গ্রেডা বই ও ফ্যাশন ম্যাগাজিন গুলোর ইলাস্ট্রেশনের কাজ করতেন। লিলি এলবেতে পরিণত হবার পর অাইনার অার কখনও পেইন্টিং করেন নি কারণ তিনি ভাবতেন পেইন্টিং ছিলো অাইনারের অংশ, যাকে তিনি পুরোপুরি পেছনে ফেলতে চেয়েছিলেন।
অাইনার অার গ্রেডা ইতালি ও ফ্রান্সে কিছুকাল অতিবাহিত করার পর ১৯১২ তে প্যারিসে স্থায়ী হবার সিদ্ধান্ত নেন যেন এলবের নারী পরিচয় নিয়ে নতুন জীবন অতিবাহিত করাটা সহজতর হয়।
এলবে নারীদের পোষাক পরিধান শুরু করেন গটলিয়েবের অাঁকাঅাঁকির কাজে সাহায্য করার জন্য। মডেলের অনুপস্থিতিতে , এলবেকে মডেলের স্টকিং অার হিলজুতো পরিধান করিয়ে অাঁকার কাজ করেন গ্রেডা। এলবে অাবিস্কার করেন মেয়েদের পোষাকে তিনি মোটেও অস্বস্তিবোধ করছেন না বরং তিনি নিজের ভেতর এক নারীসত্তাকে ভীষণভাবে উপলব্ধি করছেন। পরবর্তিতে গটলিয়েবের অাঁকা সেই চিত্রকর্মগুলো ভীষণভাবে জনপ্রিয় হতে থাকে , যেখানে একজন সুন্দরী নারীকে শিকার করতে বা কাঠবাদাম অাকৃতির চোখের নারীটিকে তখনকার অভিজাত ফ্যাশনে দেখা যেতে থাকে। ১৯১৩ সনে সবাই বেশ বড় ধাক্কা খায় যখন তারা বুঝতে পারে গটলিয়েবের মডেলটি স্বয়ং তার স্বামী অাইনার , যাকে অন্যরা অাইনারের কাজিন হিসেবে এলবে নামে চিনে এসেছে।
১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালে এলবে নিয়মিতভাবে মহিলাদের পোষাক পরিধান করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে থাকেন , নিজের বাড়িতেও অতিথিদের মনোরন্জন করতে থাকেন। প্যারিসের কার্নিভালের সময়গুলোতে সেরা সাজসজ্জায় তিনি ভীড়ের মধ্যে মিশে যেতে ভালোবাসতেন।
১৯৩০ তে, যখন জার্মানীতে লিঙ্গ পরিবর্তনমূলক অপারেশন সবে মাত্র পরীক্ষামুলক ভাবে শুরু হতে যাচ্ছে , তখন এলবে সিদ্ধান্ত নেন জার্মানীতে যাওয়ার। দুই বছর ধরে চারটি অপারেশন হয় তার। তিনটি অপারেশন ও নিজের বৈবাহিক জীবনের অানুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটিয়ে তিনি চতুর্থ অপারেশনের জন্য জার্মানী ফেরেন।
ততদিনে তিনি ডেনমার্কে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন এবং অাইনত নিজেকে মহিলা হিসেবে নাগরিকত্ব পাইয়েছেন।
এ সময়ের ভেতর লিলি একজন ফরাসী অার্টডিলারের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন, যার নাম ক্লদ লেজুনেত। লিলি স্বপ্ন দেখতেন চতুর্থ সর্বশেষ সার্জারীর পর তিনি ক্লদের সাথে ঘর বাঁধবেন যেখানে তার নিজের সন্তান থাকবে।
১৯৩১ এর জুনে ফাইনাল সার্জারীতে ডাক্তাররা চেয়েছিলেন এলবের দেহে একটি নারী যোনীপথ এবং জরায়ুর প্রতিস্থাপন করতে। প্রক্রিয়াটি ছিলো তখন একেবারেই পরীক্ষামুলক ও নবীন।
এলবের শরীর সেই জরায়ু ট্রান্সপ্লান্ট প্রত্যাখ্যান করে , যার ফলে ভয়াবহ ইনফেকশনে অাক্রান্ত হন তিনি।
সে বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর, সার্জারীর তিন মাস পরে ইনফেকশনজনিত কারণে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
লিলি তার ছোট্ট জীবনের অনেক স্বপ্নই হয়তো পুরোন করে যেতে পারেন নি, তবে গ্রেডার অকৃত্রিম ভালোবাসা অার বন্ধুত্বের হাত তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি পাওয়া।
২০০০ সালে ডেভিড এবারশোফ ” দ্যা ডেনিশ গার্ল” নামক বই লেখেন লিলি এলবেকে কেন্দ্র করে। বইটি অান্তর্জাতিক বেস্টসেলার ও ডজনখানেক ভাষায় অনূদিত হয়। ২০১৫ সালে একই নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায়, যেখানে অভিনেতা এডি রেডমায়েনকে দেখা যায় লিলি এলবের ভূমিকায়।