
আগুর পাখি বলে মানেন অনেকে। পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৯ বছর। কিন্তু সময়ের তুলনায় তার মত আলোড়ন আর ক’জন তুলতে পেরেছে? সে হিসাব কষলে, তিনি একাই ইতিহাস কাপিয়েছন। তিনি সেই প্রাচীন মিসরের বিখ্যাত রানী ক্লিওপেট্রা। যার নামের সঙ্গে মিশে আছে সৌন্দর্য, মোহনীয়তা,ক্ষমতা আর প্রচন্ড উচ্চাভিলাস।
প্রাচীন মিসরের নাম যারা জানেন তাদের কাছে ক্লিওপেট্রা অবিসংবাদিত। জানা যায় যে তিনি গলিত মুক্তা পান করতেন সমগ্র জাতির শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পাওয়া জন্য। এই মুক্তা তার সৌন্দর্যের লাভণ্যময়ী দেহকে আরো সমৃদ্ধ রুপ দিত। তার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট ছিল সমগ্র জাতি। সবাই তার পারম্পরিক জীবন সম্পর্কে না জানলেও মিশরের অনেক বড় বড় বীর রাজাগনসহ রাজপুত্ররাও তার প্রেমে বিভোর ছিল। অতএব, সর্বকালের সেরা ক্ষমতাবান নারীর তালিকায় তাকে উপরের দিকে রাখলে কি ভুল হবে?
ক্লিওপেট্রার রুপ লাভণ্য গল্প বরাবর উচ্চারিত হয়েছে। তবে মিশর কাপানো ক্ষমতা যার মুঠোবদ্ধ ছিল তাকে নিয়ে কৌতূহল অন্য উচ্চতার। সেটা যুগে যুগে হাজার মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে। মিশরের রানী ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে বহু মিথ ছড়িয়ে আছে মানুষের মনের ভিতরে ও বাইরে। ইতিহাস বেত্তা থেকে শুরু করে ঔপন্যাসিক নাট্যকার ফিরে ফিরে ক্লিওপেট্রাকে ঘিরে লিখেছেন হাজার হাজার পৃষ্টা। মঞ্চে উঠেছে তার সেই পুরনো ট্র্যাজেডি। বিখ্যাত লেখক উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘ অ্যান্টিনিও এন্ড ক্লিওপেট্রা’;জর্জ বানার্ড শ’এর “সিজার ক্লিওপেট্রা’; জন ডাইডনের ” অল ফর লাভ” ;হেনরি হ্যাগার্ডের “ক্লিওপেট্রা”। শুধু সেই সময়েই নয়;ইতিহাস কাপানো কিংবদন্তি এই নারী এখনও বহু পুরুষের কাছে আকাঙ্ক্ষিত।
মিশরের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিল ক্লিওপেট্রার একক আধিপত্য। সে সময়ে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ অব্দ। মিশর জয় করেন বীর আলেক্সান্ডার। সেই জয়ের স্মারক হিসেবে তিনি নতুন এক নগরী স্থাপন করেন। এ সূত্রে বীর আলেকজান্ডার নামানুসারে নগরের নাম রাখা হয় আলেকজান্দ্রিয়া। তারপর মিশর শাসন করেন গ্রিসের টলেমাইক বংশ। ক্লিওপেট্রা এই বংশেরই রাজকন্যা।তার বাবা ইরিয়াক-২ এর রাজত্বকালে তার মা মারা যাওয়ায় সম্প্রতি তিনি তার বাবার সাথে রাজ সভায় বসতেন এবং সমস্ত সমস্যা সমাধানে অংশিদার থাকতেন। পরবর্তীতে তার বাবার মৃত্যুর পর তিনি একাই ফারাও হিসেবে বসেন মিশরের সিংহাসনে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নারী শাসক ক্লিওপেট্রা সপ্তম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনিই ছিলেন মেসোডনিয়ার বংশোদ্ভূত সপ্তম মিশরীয় নারী।অশিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে রোম সম্রাট টলেমি অলেতিস মারা যান। এই বিশাল সম্রাজ্যের উত্তরাধিকার কে হবে এ নিয়ে চারদিকে আলোচনা শুরু হয়। অবশেষে তিনি বেছে নিলেন তার পুত্র টলেমি ও ক্লিওপেট্রাকে। বস্তুত,টলেমি অলেতিসই ছিলেন ক্লিওপেট্রার পিতা। ক্লিওপেট্রার বয়স তখন মাত্র ১৮ বছর। অলেতিস সমস্ত সম্রাজ্য উইল করেন টলেমি ও ক্লিওপেট্রার নামে। অবশ্য এও বলে যান এই বিশাল সম্রাজ্য রোমান নেতা পম্পেও দেখাশোনা করবেন৷ শুধু রাজ্য নয় তার সন্তানদের দেখাশুনার দায়িত্বও তার হাতে দিয়ে যান। তবে, সমস্যা দেখা দিল অন্যখানে। সে সময়ে মিশরের যে আইন,তাতে দ্বৈত শাসনের বাধ্যবাধকতা ছিল রানী ক্লিওপেট্রার জন্য। আর সে নিয়মানুসারে তার একজন সঙ্গী থাকা আবশ্যক ছিল। যে কারণে ক্লিওপেট্রার কাছে বিয়ে ব্যতীত অন্য উপায় ছিল না। রাজরক্ত রক্ষায় তাকে তার ছোট ভাই টলেমীকেই বিয়ে করতে হয়। টলেমির বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। এই বিয়ের ফলে ক্লিওপেট্রার দ্বৈত শাসনের কোন আইন বাধা পায়নি।বিয়ের পর পুরো রাজ্য ক্লিওপেট্রার হাতে এসে গেল।
ক্লিওপেট্রা ও তার স্বামী ১২ বয়সী ছোটভাই টলেমি পুরো মিশরের দায়িত্ব নিল। এটা বলা বাহুল্য, যে আদিতে ক্লিওপেট্রাই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। তার রাজ্য শাসন নিয়ে অনেক কিছুই জানা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে,তার রাজ্যের উপর অনেক ঝড় ঝাপটা এসেছে। সাহসীকতা আর বুদ্ধিমত্তার জোরে তিনি যেভাবে মিশরকে আগলে রাখতে চাইলেন তা যথেষ্ট ছিল না। তবুও ক্ষমতায় আরোহণের পর নানা প্রতিকূলতায় তিনি তা শাসন চালিয়ে যান। তার রাজ্যে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ৪৮ খ্রিস্টপুর্বাব্দে। ফারসালুসের যুদ্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাপতি পম্পে পরাজিত হন। সে বছরই আলেকজান্দ্রিয়ায় ফেরার পথে ফারসালুসের হাতে পম্পে নিহত হন। যুদ্ধ থেকে পালাতে গিয়ে ক্লিওপেট্রার স্বামী ও ছোটভাই টলেমি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা হয়ে ওঠেন মিশরের একমাত্র রানী। পুরো রাজ্যভার তার হাতে।একদিকে সেনাপতি পম্পের পরাজয় ও নিহত অন্যদিকে স্বামী ও ছোট ভাই টলেমির মৃত্যু এই দুই শোকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি অবশেষে একাই মিশরের সিংহাসনে বসেন। ক্ষমতার পুরো পেয়ালা হাতে আসার পর ক্লিওপেট্রার মিশরের দেখা মিলে। তারপর থেকেই ক্লিওপেট্রার জীবনে আসতে থাকে নানা গল্প।
শুরুতেই আবির্ভাব ঘটে রোমের পরাক্রমশালী বীর মার্ক অ্যান্টিনির।ক্লিওপেট্রার বুদ্ধিমত্তা আর সৌন্দর্য পূর্বেই পুরো মিশর ছড়িয়ে গিয়েছিল। লোকমুখে সে কথা অ্যান্টিনিও’র কানে পৌঁছে। অ্যান্টিনিও চাইলেন যে কোনো ভাবে তিনি ক্লিওপেট্রার সাথে সাক্ষাৎ করবেন। সেই উদ্দেশ্যে রোম থেকে অ্যান্টিনিও ক্লিওপেট্রার রাজকীয় প্রাসাদে এলেন। প্রথম দেখাতেই তিনি ক্লিওপেট্রার মন জয় করে নেন। অবশ্য, কারো কারো মতবাদ মিশর আক্রমণ করতে এসে ক্লিওপেট্রার প্রেনে পড়ে যান এই রোমান বীর অ্যান্টিনিও।অ্যান্টিনিও কিন্তু বিবাহিত ছিলেন তার সত্ত্বেও তিনি ক্লিওপেট্রাকে মনে -প্রাণে ভালবেসেছিলেন।বলা যায়, তারা দুজনেই প্রেমের আগুনে জ্বলছিলেন। তবে ক্লিওপেট্রার দ্বৈত শাসনের হিসাব পুরোপুরি পাল্টে গেছে। অ্যান্টিনিও কে ভালবেসে ক্লিওপেট্রার শুধু প্রেমই হয় নি তিনি তার সঙ্গে মুফতে পেয়েছিলেন সিংহাসন রক্ষায় এক পরাক্রমশালী বীরের সমর্থন। তবে অ্যান্টিনিও’র স্ত্রী ফুলভিয়ার মৃত্যু এবং সেনাপতি পম্পের মৃত্যুর সাথে কঠোর প্রাঙ্গনে বিদ্রোহ অ্যান্টিনিও এবং ক্লিওপেট্রার জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। হটাৎ রোমে শুরু হয় গৃহযুদ্ধএর দাবদাহ। আসে ক্লিওপেট্রার গল্পের ভিন্নমাত্রা। তবুও এই এলোমেলো জীবনে ক্লিওপেট্রার সঙ্গে আবির্ভাব ঘটে মধ্যবয়সী বীর জুলিয়াস সিজারের।
বীরত্বে অন্ধ হয়ে ক্লিওপেট্রা জুলিয়াসকেও তার জীবনে আকড়ে ধরেছিলেন। তবে তাতে শেষ রক্ষা হয় নি। এই প্রেম ধংস করে দেয় তাদের জীবন। রাজাদের জীবনের দুঃসময় শেষ করে দিয়ে যায়। প্রেমের অপবাদে পাগল হয়ে বীর অ্যান্টিনিও আত্নহত্যা করেন। সেই প্রেমের শোকে ক্লিওপেট্রাও মৃত্যুকে বেছে নেন। তিনি মিশরীয় বিষধর গোখরা সাপের দংশন বা বিষ পান করে আত্নহত্যা করেন।
ক্লিওপেট্রা ও অ্যান্টিনিও’র একটা সন্তান ছিল। তার নাম সিজারিয়ান। অতএব এদের মৃত্যুর পর মিশরের সিংহাসনে সিজারিয়ান-ই বসার কথা কিন্তু জুলিয়াস সিজার তাকে নাম মাত্র ফারাও করে রাজ সভায় বসিয়ে মিশরের সমস্ত ধন-ভান্ডার লুন্ঠন করেন এবং পরিশেষে তিনি নিজে সিংহাসনে বসেন। শুরু হয় মিশরে রোমান শাসন। হারিয়ে যায় ক্লিওপেট্রার চিহ্ন।
তবে তাকে নিয়ে সেই কৌতূহল আজও শেষ নেই। আগ্রহীরা এখনও তার শেষ চিহ্নটুকু খোঁজেন।
ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ ছিল অ্যান্তিরহোদোস দ্বীপে। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে এক ভয়ানক ভুমিকম্প এবং সুনামিতে ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ সহ এই দ্বীপটি গ্রাস করে ভূমধ্যসাগর। ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ এবং সম্রাজ্য আজও ঘুমিয়ে আছে ভুমধ্যসাগরের নিচে। আলেকজান্দ্রিয়া শহরের উপকূলেই ছিল এই দ্বীপ। প্রায় এক হাজার ছয়শ বছর আগে ভুমিকম্প আর সুনামিতে তলিয়ে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বাতিঘর।