মঙ্গোল শাসনে প্রায় বিধ্বস্ত চিনে ১৩৩৪ সালে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় প্লেগ মহামারী। বিশ্বে যা পরিচিত হয়েছিল ব্ল্যাক ডেথ নামে। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মহামারী যা অস্বাভাবিক মারণক্ষমতা নিয়ে প্যানডেমিক হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা বিশ্বে। পরের ১১ বছরে এশিয়াতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ মেরে ইউরোপের পথ ধরেছিল ব্ল্যাক ডেথ।
মঙ্গোল সেনা ও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সিল্ক রুট ধরে ১৩৪৫ সালে ভয়াবহ প্লেগ পৌঁছে গিয়েছিল দক্ষিণ রাশিয়ার ভলগা নদীর উপত্যকায়। ১৩৪৭ সালে পৌঁছে গিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর কন্সটানটিনোপল বা আজকের ইস্তানবুলে। ওই বছরেই ব্ল্যাক ডেথ প্রবেশ করেছিল রাশিয়ার দক্ষিণে কৃষ্ণসাগরের গায়ে লেগে থাকা ক্রিমিয়ার বন্দর শহর কাফফাতে (বর্তমানে ফিওদোসিয়া)।
রিপাবলিক অফ ভেনিস তখন ক্রিমিয়া শাসন করলেও জানি বেগ নামে এক মঙ্গোল সেনাপতি কাফফা দখল করে নিয়েছিলেন। চিন ফেরত মঙ্গোল সেনারা ভয়াবহ ভাবে প্লেগে আক্রান্ত হয়েছিল। মৃত মঙ্গোল সেনাদের শবদেহ কাফফা শহরের উঁচু সীমান্ত প্রাচীরে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। কালো ইঁদুর ও ছোটখাটো প্রাণীর গায়ে থাকা পতঙ্গ জেনোফিলিয়া চিয়োপিস-এর মাধ্যমে প্লেগ রোগের জীবাণু ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস ছড়িয়ে গিয়েছিল কাফফাতে। প্লেগে আক্রান্ত হয়েছিলেন কাফফা শহরের মানুষজন।

ব্ল্যাক ডেথ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল অস্বাভাবিক গতিতে
১৩৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ইতালীয় ব্যবসায়ীদের ১২ টি বানিজ্যিক জাহাজ ইউরোপে নিয়ে এসেছিল প্লেগ। জাহাজে থাকা কালো ইঁদূরের সঙ্গে প্লেগ কন্সটানটিনোপল থেকে ঢুকে পড়েছিল ভূমধ্যসাগরের সর্ববৃহৎ দ্বীপ সিসিলিতে। যেটি ইতালির অধীনে ছিল। সিসিলি থেকে ১৩৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ব্ল্যাক ডেথ ইতালির জেনোয়া ও ভেনিস পৌঁছায়। কিছু দিনের মধ্যেই দেখা দেয় পিসায়। এরপর সারা ইতালিতে ছেয়ে যায় ভয়াবহ প্লেগে। ইতালীয় সাহিত্যিক জিওভান্নি বোকাচ্চিওর ১৩৪৮ সালে লেখা ডেকামেরন উপন্যাসে উঠে এসেছিল ব্ল্যাক ডেথের ভয়ঙ্কর উপসর্গগুলি। ইতালি হয়ে উঠেছিল মৃত্যুপুরী।
এরপর ইতালিকে সেতু করে ব্ল্যাক ডেথ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ইউরোপে। ১৩৪৮ সালের জুন মাসে প্লেগ আঘাত হেনেছিল পর্তুগাল ও ইংল্যান্ডে। জুলাই মাসে ফ্রান্সে ও স্পেনে। মেতে উঠেছিল মারণলীলায়। ভয়াবহ গতিতে ব্ল্যাক ডেথ ছড়িয়ে পড়েছিল, সংক্রমণে সাহায্য করেছিল আবহাওয়া, যুদ্ধ, অপুষ্টি ও ইউরোপবাসীর দূর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ১৩৪৯ সালে ব্ল্যাক ডেথ আক্রমণ করেছিল নরওয়ে, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল আইসল্যান্ডে। ১৩৫০ সালের মধ্যে গ্রাস করেছিল জার্মানি স্কটল্যান্ড ও স্ক্যান্ডেনেভিয়াকেও।

ইউরোপের কাছে সম্পুর্ণ নতুন এই রোগটির চিকিৎসা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না সে যুগের চিকিৎসকেরা। তাঁরা বিভিন্নভাবে আক্রান্তদের বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন। পেঁয়াজ খাইয়ে, দশ বছর পুরানো গুড়ের সিরাপ খাইয়ে, পান্নার গুঁড়ো খাইয়ে, নর্দমার পাশে বসিয়ে, দুটি অগ্নিকুণ্ডের মাঝখানে বসিয়ে, জুড়িবুটি পুড়িয়ে ধোঁয়া তৈরি করে। কিছুতেই কিছু হয়নি। ধার্মিকরা ভেবেছিলেন ব্ল্যাক ডেথ হল ঈশ্বরের দেওয়া শাস্তি। আক্রান্তরা পাপ করেছিলেন, তাই তাদের পাপের জন্য চার্চে প্রার্থনা করলে মুক্তি পাওয়া যাবে। শুরু হয়েছিল সমবেত প্রার্থনা। না সেদিনও ঈশ্বর বাঁচাতে পারেননি, কারণ ভিড় থেকে রোগ ছড়িয়েছিল আরও বেশি। আরও মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
বিপদের সময় গুজবের পরিণতি হয়েছিল মারাত্মক
প্লেগের নারকীয় ধ্বংসলীলার মাঝেই ১৩৪৯ সালেএক ভয়ঙ্কর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। ইহুদিরা নাকি এই রোগটি ছড়িয়ে খ্রিস্টানদের মেরে ফেলছে। যাতে তাদের ধর্মের আধিপত্য সারা বিশ্বে কায়েম হয়। গুজব রটে ইহুদিরা নাকি সুইৎজারল্যান্ডের কুয়োতে জীবাণু মিশিয়ে দিয়েছে। গুজবের ফল হয়েছিল আরও ভয়াবহ, প্যানডেমিকের মধ্যেই ইউরোপ জুড়ে খ্রিস্টানরা দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করতে শুরু করেছিল ইহুদিদের। চলেছিল গণহত্যা, বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া।

একইসঙ্গে ইউরোপীয় জনতার রাগ গিয়ে পড়েছিল বহিরাগত ও কিছু বিশেষ জনগোষ্ঠীর ওপর। প্লেগ সংক্রমণের জন্য তাদেরও দায়ী করা হয়েছিল। ইউরোপীয়দের প্রাণঘাতী আক্রমণের শিকার হয়েছিল বিদেশী, ভিক্ষুক, তীর্থযাত্রী, জিপসি, কুষ্ঠ ও সোরিয়াসিসের রোগীরা। ইউরোপে এই সব গোষ্ঠীর মানুষদের মেরে ফেলা হয়েছিল অকাতরে। অবস্থা হাতের বাইরে চলে যেতে থাকায়। খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপ ষষ্ঠ ক্লেমেন্ট একটি ধর্মীয় আদেশে বলেছিলেন, “প্লেগ এনেছে ঈশ্বরের ক্রোধ, যা সৃষ্টি হয়েছে খ্রিস্টানদের পাপের জন্য।” এর ফলে থেমে যায় মানুষের মানুষ মারা। কিন্তু থামেনি ব্ল্যাকডেথ, নারকীয় হত্যালীলা চালিয়ে গিয়েছিল।
মৃতের পাহাড় দেখেছিল ইউরোপ
১৩৫১ সালে নভগোরড ও পিস্কভ শহর দিয়ে রাশিয়ায় প্রবেশ করেছিল ব্ল্যাক ডেথ। ১৩৫২ সালে পৌঁছে গিয়েছিল মস্কোতে। যা কাফফা থেকে মাত্র কয়েকশো কিলোমিটার দূরে। সেই কাফফা, কন্সটান্টিনোপলের সঙ্গে দ্বিতীয় যে বন্দরটিকে প্লেগ ইউরোপে ঢোকার পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিল। এইভাবে এক বৃত্তাকার পথে ব্ল্যাক ডেথ তার প্রথম এবং ভয়ঙ্করতম ইউরোপ ভ্রমণ সম্পূর্ণ করেছিল, মধ্য যুগের ইউরোপের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ নাগরিককে মেরে ফেলে।
প্যারিসের ১০০০০০ মানুষের মধ্যে অর্ধেকই ব্ল্যাক ডেথে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। ১৩৩৮ সালে ইতালির ফ্লরেন্সের জনসংখ্যা ছিল ১২০০০০, তা ১৩৫১ সালে নেমে হয় ৫০০০০। হামবুর্গ ও ব্রেমেন শহরের জনসংখ্যা ৬০%. কমে গিয়েছিল। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও আয়ারল্যান্ডের প্রায় ৩২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। ১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সালের মধ্যে খোদ লন্ডনে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬২০০০ মানুষ।

ইতিহাসবিদ ফিলিপ ডেইলিডার ২০০৭ সালে বলেছিলেন, এমন অস্বাভাবিক মারণক্ষমতা এর আগে দেখেনি মানব সভ্যতা। মাত্র চার বছরে ইউরোপের জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ব্ল্যাক ডেথ একটানা চার বছর আক্রমণ চালিয়েছিল ইতালি, দক্ষিণ ফ্রান্স ও স্পেনে । এইসব দেশের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। জার্মানি ও ইংল্যান্ড হারিয়েছিল তাদের ২০ শতাংশ নাগরিককে।
নরওয়ের ইতিহাসবিদ ওলে বেনেডিক্টের হিসাব আরও ভয়ঙ্কর। তাঁর মতে, সেই সময়ে ইউরোপের জনসংখ্যা ছিল প্রায় আট কোটি। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ এই ব্ল্যাক ডেথের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। জনসংখ্যা আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে ২০০ বছর সময় লেগেছিল ইউরোপের। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় গণকবরে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল লক্ষ লক্ষ নরনারী ও শিশুকে। ইউরোপের বেশিরভাগ যাজক ও নান মারা গিয়েছিলেন, কারন তাঁরাই আক্রান্তদের সেবা করেছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে ভয়াবহ ব্ল্যাক ডেথ পৃথিবীর জনসংখ্যা ৪৮ কোটি থেকে ৩৫-৩৭ কোটিতে নামিয়ে এনেছিল।
ইতালি আবিষ্কার করেছিল ‘কোয়ারেন্টাইন’ পদ্ধতি
১৩৭৪ সালে আবার ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথ দেখা দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল সেই ইতালিকে দিয়েই। ব্ল্যাক ডেথ আক্রমণ করেছিল ভেনিস শহরকে। ছাব্বিশ বছর আগের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছিল ভেনিস। ভেনিসের প্রশাসন প্লেগে আক্রান্তদের থেকে শহরের সুস্থ মানুষদের আলাদা করা শুরু করেছিল। ১৩৭৪ সালেই ভেনিসের আগে এই কৌশল অবলম্বন করেছিল অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে থাকা রিপাব্লিক অফ রাগুসা(বর্তমানে দক্ষিণ ক্রোয়েশিয়ার ডুব্রভনিক)।
রাগুসা দ্বীপটিতে একটি বিচ্ছিন্ন বন্দর তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে ভিনদেশী বানিজ্যিক ও পর্যটকবাহী জাহাজগুলি বাধ্যতামূলকভাবে তিরিশদিনের জন্য নোঙর করানো হয়েছিল। সমুদ্র বা সড়ক পথে আগত ব্যবসায়ী ও পর্যটকদেরও সেখানে তিরিশদিনের (ট্রেন্টাইন) জন্য বাধ্যতামূলকভাবে নির্বাসনে রাখা হয়েছিল। দেখা হয়েছিল তাঁরা অসুস্থ হন কিংবা মারা যান কিনা। তিরিশদিন পর সুস্থ থাকলে তবে মূল ভূখন্ডে প্রবেশের অধিকার মিলেছিল।

রাগুসার সাফল্যে অনুপ্রাণিত ভেনিসের সেনেটের কাছে তিরিশ দিনের নির্বাসন কম মনে হয়েছিল। ভেনিসের চিকিৎসকেরা দেখেছিলেন বুবোনিক প্লেগে আক্রান্ত হওয়া থেকে আক্রান্তের মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত সময় লাগে ৩৭ দিন। হাতে বাড়তি আরও তিনদিন রেখে ভেনিস প্রশাসন ৪০ দিনের নির্বাসন বা কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেছিল। কোয়ারেন্টিনা বা কোয়ারেন্টা জিওরনি (চল্লিশ দিন) নামক ইতালিয় শব্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল কোয়ারেন্টাইন শব্দটি।
এই সময় ভেনিস শহরের সীমানা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বিদেশি জাহাজগুলিকে মাঝ সমুদ্রে চল্লিশদিন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। শহরবাসীকে বাড়িতে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। জনসমাগম নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতির সাহায্যে সেদিন নিজেকে ও সারা ইতালিকে অস্বাভাবিক দক্ষতায় বাঁচিয়ে দিয়েছিল ভেনিস।
লেখকঃ রূপাঞ্জন গোস্বামী